রাঙ্গাবালী পটুয়াখালী প্রতিনিধি: অপার এক সৌন্দর্যের নাম সোনার চর। বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে ওঠা অপরূপ প্রাকৃতিক এক লীলাভূমি। পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার দক্ষিণে চরমোন্তাজ ইউনিয়ন সীমান্ত ঘেঁষে এই চরের অবস্থান। ১০ হাজার একর আয়তনের চরটি দুর্গম হলেও প্রকৃতিক সৌন্দর্যের কমতি নেই।
সুন্দরবন বা কুয়াকাটা নামের পেছনে যেমন একটি গল্প আছে, তেমনি সোনার চরের নামের পেছনেও কারণ আছে। চরটি সোনা দিয়ে তৈরি না হলেও সূর্যের প্রখর রোদ যখন বালুর ওপর পড়ে তখন সোনার মতোই মনে হয়।
লোকের মুখে মুখে নামটি জনপ্রিয়তা পায়। ফলে একসময় এটি প্রশাসনিক নামে রূপ নেয়। পটুয়াখালী প্রশাসনের ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, ২০০৪ সালে বঙ্গোপসাগরের কোল জুড়ে জেগে ওঠে চরটি। আয়তনের দিক থেকে সুন্দরবনের পরেই এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশাল সমুদ্র সৈকত। ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ২০ হাজার ২৬ হেক্টর আয়তনের এই বনভূমিকে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এরপর থেকেই বনায়ন শুরু করে বন কর্তৃপক্ষ।
ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে সোনারচর নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আধার। যেতে যেতে দেখতে পাবেন সাগরের অপরূপ দৃশ্য। ছোট-ছোট নৌকা চলছে বড়-বড় ঢেউয়ের তালে। বিভিন্ন ধরনের জাল ফেলে মাছ ধরছে জেলে। সাগর থেকে আসা খালগুলোতে মাকড়শার মত অসংখ্য ঠেলা জাল দিয়ে মাছ ধরছে শিশুরা। সাগরে যখন জোয়ারের জল উথলে ওঠে তখন চাঁদের আলোয় অন্য এক সৌন্দর্যে রূপ নেয় সোনার চর।
দূর থেকে চরের ওপর বনের দৃশ্য অবাক করার মতো। একটু কাছাকাছি গেলে সহজেই চোখে পড়বে মেছো বাঘ, বুনো মোষ, হরিণ, বানরসহ আরো সব বন্য প্রাণী। এছাড়া গাছে গাছে নানা ধরনের পাখিদের দেখা মেলে। যাদের কলকাকলিতে নিশ্চয়ই আপনি মুগ্ধ হবেন। এসব দেখতে হলে খুব সকালেই বেরিয়ে পড়তে হবে নৌকা নিয়ে। সৈকতে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যাবে সূর্যাস্ত কিংবা সূর্যোদয়ের মনোরম দৃশ্য। এখানে রয়েছে প্রায় ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। তীরে আছড়ে পড়ছে ছোট-বড় ঢেউ। ঝুরঝুরে বালি গলে পড়ছে নোনা জলে।
সৈকতে বিচরণ করছে লাল কাঁকড়া। কাঁকড়ার এ প্রজাতি সামুদ্রিক হলেও চরের বালুমাটিতে বাস করে। বালুর গভীরে নিজেদের তৈরি সুড়ঙ্গে দলবেঁধে চলাচল করে। জোয়ারের পানিতে সৈকত যখন ডুবে যায়, তখন এরা সুড়ঙ্গে নিরাপদে আশ্রয় নেয়। এছাড়া চোখে পড়বে ডানা ঝাপটানো নাম না জানা পাখির দল। তাদের কিচির-মিচির শব্দে সন্ধ্যার পরিবেশটুকু উপভোগ করা যাবে নিজের মতো করে। এছাড়া দেখতে পাবেন সমুদ্রগামী হাজারো জেলের জীবন সংগ্রামের দৃশ্য। সমুদ্রের নীল জলরাশি আর সবুজ প্রকৃতির এমন নিরিবিলি জায়গা সহজে কোথাও পাওয়া যাবে না।
এটি যেহেতু রিজার্ভ বন, তাই আপনি এখানে বাইরের লোক। বণ্যপ্রাণীদের বিরক্ত করলে তারাও হিংস্র হয়ে উঠবে- এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আর আবহাওয়ার পরিবর্তন সমুদ্রকে আরও ভয়াল করে তুলতে পারে। তাই এখানে গেলে শীতের সময় সবচেয়ে ভালো। এর পাশাপাশি অবশ্যই আবহাওয়ার তথ্য জেনে যেতে হবে। ক্যাম্পিং-এর বিকল্প ব্যবস্থাও ভেবে রাখতে হবে। সমুদ্র তীরে বিপদ সংকেত আছে কিনা খেয়াল রাখুন। খেয়াল না করলে কক্সবাজারের মতো আপনাকে সতর্ক করতে এখানে কেউ ছুটে আসবে না। এমনকি বিপদে পড়লে উদ্ধার বাহিনী আসতেও অনেক সময় লাগবে।
পর্যটন শিল্পে এখন প্যাকেজ ট্যুরের বিষয়টি বেশ পরিচিত। পারিবারিকভাবে তো বটেই, সবাই মিলে একসঙ্গে দলবেঁধে ঘুরে বেড়াবার মজাও কিন্তু কম নয়। ঢাকা থেকে আসা বেশির ভাগ পর্যটকই এই জেলার আরেকটি পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা এসে ঘুরে চলে যান। কিন্তু সোনার চর, রূপার চর, চর মৌডুবী, জাহাজমারা, তুফানিয়া, চর ফরিদ, শিপচরসহ সমুদ্রফুঁড়ে জেগে ওঠা সবুজ বনাঞ্চলের সন্ধান জানেন না অনেকেই। দ্বীপগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করলে দেশের পর্যটন শিল্পে যোগ হবে নতুন মাত্রা। তাই বনাঞ্চলকে পর্যটনমুখী করতে আগে দরকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। এর সাথে নির্মাণ করা জরুরি হোটেল-মোটেল। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে।
ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চযোগে কিংবা সড়কপথে পটুয়াখালী যাবেন। সেখান থেকে গলাচিপা উপজেলা সদর হয়ে সড়কপথে দক্ষিণে পানপট্টি লঞ্চঘাট। লঞ্চঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারযোগে চরমোন্তাজ ইউনিয়ন পেরিয়ে দক্ষিণে যেতে হবে। সামনে গিয়ে বাঁক ঘুরতেই দাঁড়ছিড়া নদী। এরপরই সোনার চরের অপরূপ দৃশ্যের দেখা মেলবে।
গলাচিপা লঞ্চঘাট থেকে স্পিড বোটে সোনারে চর যেতে মাত্র দেড় ঘণ্টা লাগবে। অন্যদিকে সদরঘাট থেকে রাঙাবালীর লঞ্চে চরকাজল নামার পর ছোট লঞ্চে চরমন্তাজ গিয়ে ট্রলারে সোনার চর যাওয়া যাবে। আবার কুয়াকাটা থেকেও সোনার চরে যাওয়া যায়। যেতে হবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। কুয়াকাটা থেকে স্পিড বোট রিজার্ভ করে সোনার চর যাওয়ার সু-ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে যেতে পারেন কিন্তু সময় লাগবে ঘণ্টাতিনেক।
রাত কাটানোর জন্য এখনও সোনার চরে নিরাপদ ও আরামদায়ক ব্যবস্থা হয়ে ওঠেনি। তবে প্রশাসনের উদ্যোগে পর্যটকদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে তিন কক্ষের একটি বাংলো কিন্তু বাংলো টা ভেঙ্গে গেছে থাকার মতো সেখানে উপজুগি না। এছাড়া রয়েছে বন বিভাগের ক্যাম্প। সেখানে কিছুটা কষ্ট হলেও পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা আছে।
থাকতে চাইলে চলে যেতে পারেন চরমোন্তাজ। সেখানে এম আজাদ খাঁন সাথী রেস্ট হাউজ, এবং বন বিভাগ, স্যাপ বাংলাদেশ ও মহিলা উন্নয়ন সমিতির ব্যবস্থাপনায় রাত যাপনে জন্য বাংলো রয়েছে ।
এব্যাপারে ১১৪ পটুয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মহিব্বুর রহমার মহিব বলেন, রাঙ্গাবালীর সোনারচর, চরহেয়ার, জাহাজমারা সমুদ্র সৈকত দীর্ঘদিন ধরে পর্যটন বিকাশের সুযোগের অপেক্ষায়। আমি এ ব্যাপারে সংসদে একাধিকবার বক্তব্য দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী সোনারচরের ব্যাপারে অবগত আছেন। সোনারচর নিয়ে আমাদের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। সোনারচর হবে বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র।