শাহাদাৎ হোসেন ইমরানঃ
পরনে থ্রি পিচ। চালচলনে মেয়েলি ভাব। বেশির ভাগ সময় সাজুগুজু থাকতেই পছন্দ তাদের। মেকাপ আর ঠোঁটে লপিস্টিক যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। মূলত এই নারী বেশের আড়ালে কিছু পুরুষ সংঘবদ্ধ হয়ে হিজড়া বেশে যাত্রীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বাসে বেপরোয়া চাঁদাবাজি করছে।
রাজধানীর গণপরিবহণে হিজড়াদের (তৃতীয় লিঙ্গ) চাঁদা আদায়ের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। ঢাকার একাধিক পয়েন্টে হিজড়াদের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন পরিবহণ যাত্রীরা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তারা এই জনগোষ্ঠীর কাছে রীতিমতো অসহায়। চলার পথে দুই থেকে তিন জায়গায় তাদের চাঁদা দিতে হয়। এ চাঁদা আবার ১০ টাকার কম দেওয়া যায় না; কম হলেই হতে হয় নাজেহাল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও হিজড়াদের এমন আচরণের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
খোজ নিয়ে জানা যায় , এলাকা ভাগ করে বিভিন্ন মার্কেট ও দোকানপাটে সপ্তাহে একদিন চাঁদা আদায় করেন হিজড়ারা। কিন্তুু বেশ কিছুদিন ধরে দোকানপাটের পাশাপাশি গণপরিবহণ,রিকশা এমনকি ভিবিন্ন ট্রাফিক সিগনাল এ দাঁড়িয়ে থাকা সিএনজি যাত্রীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে তারা। রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর,উত্তরা,খিলখেত,বনানি,মহাখালি, কুড়িল,বাড্ডা,মগবাজার,ফার্মগেট সহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গণপরিবহণে উঠে তারা। যাত্রীরা চাঁদা দিতে না চাইলে অশ্লীল সব কৌশল অবলম্বন করে হিজরারা।কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ও মধ্যবয়সি পুরুষরা এদের টার্গেট থাকে সবার প্রথমে।সুন্দর ব্যবহার দিয়ে শুরু করলেও টাকা না দিতে অস্বীকার করলে অশ্লীল আচোরণ শুরু করে।বিভিন্ন বাসে এদের মারমুখী আচরণে অনেকেই হেনস্তার শিকার হন। অনেকটা ভীত হয়ে টাকা দিতে বাধ্য হয় পরিবহন যাত্রীরা।
রাজধানীর খিলখেত থেকে ভিক্টর পরিবহণের একটি বাসে উঠেন দুজন হিজড়া। যাত্রীদের কাছ থেকে তারা ১০ টাকা করে আদায় করেন। যাত্রীরা টাকা না দিতে চাইলে তারা ওই যাত্রীকে নাজেহাল করে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় নেমে যায়। বাসে থাকা যাত্রী বাবুল দফাদ্দার বলেন,রামপুরা অফিস যাচ্ছি প্রায় দিনই এদের ১০ টাকা করে দিতে হয়। ভাটারার দিকে গেলে আবার চাঁদা দিতে হয়। এমনিতেই বাস ভাড়া বেশি। মানুষ কয়বার হিজড়াদের টাকা দেবে। এসব দেখার কি কেউ নেই?
বলাকা পরিবহণে বনানি এলাকা থেকে তিন হিজড়া উঠে চাঁদা নিতে দেখা যায়। তাসফিয়া নামের এক হিজড়া বিজয় বাংলাদেশকে বলেন, আমরা ইচ্ছা করে চাঁদাবাজি করি নারে ভাই। পেটের ভাতের জন্য বাসে উঠি। হাত পেতে মানুষের কাছ থেকে টাকা নি। কেউ আমাদের একটা চাকরি দেউক। তাইলে আর টাকা তুলতে আসপো না। মহাখালি এলাকায়ও দেখা গেছে একই চিত্র। বাস ও রিকশা যাত্রীদের কাছ থেকে হিজড়ারা টাকা তুলছেন। হাতেগোনা কিছু হিজড়া ভালো আচরণ করলেও অধিকাংশই আক্রমণাত্মক। যাত্রীদের সঙ্গে পরিবারের কোনো সদস্য থাকলে হিজড়ারা আরও বেশি অপদস্থ করে। এতে যাত্রীরা সম্মান বাঁচাতে হিজড়াদের চাহিদা পূরণে বাধ্য হন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে হিজড়াদের অশ্লীল আচরনে ভিবিন্ন সময়ে গ্রেফতার করছেন।কিছুদিন যেতে না যেতেই তৎপর হয় আবার একই অবস্থায়। নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, একেক স্থানে ৭-৮ জন করে অবস্থান নেয় হিজড়ারা। সাজসজ্জায় ভয়ংকর রূপ ধারণ করে এরা।এতে অনেকটা ভীত হয়ে উঠে বাসে থাকা যাত্রীরা। প্রতিটি বাসে দুই থেকে তিনজন উঠেন, তালি বাজানোর পাশাপাশি অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে তারা যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা তুলেন।
জানা গেছে, কিছু মেয়েলি আচরণের পুরুষকে দলে ভিড়িয়ে হিজড়া গুরুমারা তাদের পুরুষাঙ্গ কর্তন করায়। এরপর চাঁদাবাজিতে নামায়। সম্প্রতি মালিবাগের একটি লেজার পার্লারের মালিককে গ্রেফতার করেছে ডিবি। সেই পার্লারের আড়ালে মালিক হাদিউজ্জামান অন্তত ১০০ পুরুষকে হিজড়ায় রূপান্তর করেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে তিনি হাতিয়েছেন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
কয়েক মাস আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ হাদিউজ্জামান ও তার সহযোগীদের গ্রেফতারের করে। একটি চক্র এসব মানুষকে হিজড়ায় রূপান্তর করে নানা অপকর্ম করাচ্ছে। চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে নজরদারি রেখেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
সম্প্রতি হিজরাদের নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ হিজড়া কল্যাণ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবিদা সুলতানা মিতু বলেন, সরকার হিজড়াদের উন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু সঠিকভাবে কাজটা হচ্ছে না। যে কারণে হিজড়াদের দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হচ্ছে না। তিনি বলেন, সম্প্রতি ঢাকা শহরের গুরুমাদের নিয়ে আমরা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি নগর পরিবহণে হিজড়াদের কোনো ধরনের চাঁদাবাজি করা যাবে না। যদি কেউ পরিবহণে চাঁদাবাজি করে তবে এর দায়দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।তিনি আরও বলেন, সরকার যদি হিজড়াদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে তবে আমরা বাসাবাড়ি, দোকানপাটে হিজড়াদের তোলাবাজি বন্ধের ব্যবস্থা করব।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া ও জনসংযোগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন বলেন, যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়। তিনি বলেন, সরকার ও বাংলাদেশ পুলিশ এই সম্প্রদায়ের মানুষদের কর্মক্ষম ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সহানুভূতিশীল। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান ‘তৃতীয় লিঙ্গের’ এসব মানুষের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ট্রাফিক পুলিশে হিজড়াদের নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে হিজড়াদের কারও কারও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ দুঃখজনক।