নাঈম শেখ, নান্দাইল (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি: ময়মনসিংহের নান্দাইলের তিন কিশোরী,মেয়ে স্বপ্না আক্তার জিলি, সিনহা জাহান শিখা,ও তানিয়া আক্তার তানিসা বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৭ নারী ফুটবলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। তাদের স্বপ্ন ছিল ভালো কিছু করার। একদিন জাতীয় দলে সুযোগ পাবে।ফুটবল খেলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের সুনাম বয়ে আনবে।
আজ সেই স্বপ্ন তাদের হাতের মুঠোয়।স্বপ্ন পূরণ করতে তিন কিশোরী ফুটবলার ফুটবল প্রশিক্ষণে যাচ্ছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দেশ পর্তুগালে।আগামী জুলাইয়ে তারা যাবে পর্তুগালে।
বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ড কাপ টুর্নামেন্ট ২০১৮ সালে রানার্সআপ এবং ২০১৯ সালে চ্যাম্পিয়ন হয় নান্দাইল উপজেলার পাঁচরুখী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সে চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিল এই তিন কিশোরী। তারা তিনজনই বর্তমানে নান্দাইল পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।
নান্দাইলের তিন গ্রামে এই মেয়েদের নিয়ে এখন মাতামাতি।চলছে উৎসব।তাদের পরিবারগুলো বেজায় খুশী। যেন আনন্দের আর শেষ নেই।পরিবারের আনন্দের গণ্ডি পেরিয়ে গ্রাম থেকে ছড়িয়ে গেছে উপজেলার সর্বত্র।মিডিয়াকর্মীদের আনাগোনায় সরগরম গ্রামের মেঠোপথ।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় ক্রীড়া পরিদপ্তর বঙ্গমাতা নারী ফুটবলের সেরা ৪০ খেলোয়াড়কে নিয়ে বিকেএসপিতে দুই মাসের ক্যাম্প করে। ৪০ জনের মধ্যে থেকে ১৭ জন বাছাই করা হয়।এদের মধ্যে ১১ জন মূল দলে আর ৬ জন অতিরিক্ত।
শিখা,জিলি খেলবে মূল দলে আর তানিসা অতিরিক্ত ৬ জনের কাতারে। তাদের নিয়েই গড়া একটি দল এখন প্রশিক্ষণের জন্য যাবে পর্তুগালে। এই দলেই সুযোগ পেয়েছে শিখা, জিলি ও তানিসা। এরই মধ্যে এই খেলোয়াড়দের পাসপোর্ট তৈরিসহ বিদেশ ভ্রমণের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে।
উপজেলার প্রত্যন্ত অজপাড়াগাঁয়ে তাদের বাড়ি।তিনজনই দরিদ্র পরিবারের মেয়ে।কিন্তু দারিদ্রতাকে পাশ কাটিয়ে আজ তাদের খ্যাতির দ্যুতি চারিদকে। ফুটবল খেলে নিজেদের তুলে ধরেছেন আপন মহিমায়।সবার মুখে মুখে এখন শুধুই শিখা,জিলি ও তানিসা। সুধীজন, সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে তাদের নাম।
তারা তিনজনই নান্দাইল পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। শিখা ৯ম, জিলি এবং তানিসা ৮ম শ্রেণীতে পড়ে।
শিখার বাড়ি উপজেলার শেরপুর ইউনিয়নের রাজাবাড়িয়া গ্রামে। বাবার নাম বিপ্লব মিয়া।তিন বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার পর থেকেই নানার বাড়িতে বেড়ে উঠেছে সে।তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে শিখা তৃতীয়। বিধবা নানি হালিমা খাতুন তার দেখভাল করেছেন।দ্বিতীয় সংসার নিয়ে দিনমজুর বাবা অন্যত্র থাকলেও শিখার খোঁজখবর নেন নিয়মিত।নানির বাড়িতে সামান্য ভিটায় একটি জরাজীর্ণ ঘর ছাড়া আর কিছুই নেই। হাঁস-মুরগি লালন-পালন করে শিখার খরচের ব্যয় মেটান নানি হালিমা বেগম।শত প্রতিকুলতার মাঝেও নাতনির দেখভাল করছেন তিনি।
ছোটকাল থেকে খেলাধুলায় আগ্রহী ছিলেন শিখা। কোচ প্রশিক্ষক মগবুল হোসেনের মাধ্যমে উপজেলা,জেলা, বঙ্গমাতা গোল্ডকাপসহ বিভিন্ন পর্যায়ের খেলাধুলায় অংশ গ্রহণ করে শিখা।
শিখা বলেন,‘আমি একজন স্ট্রাইকার,আর যাচ্ছি রোলানডোর দেশে। আমার যে কত খুশি লাগছে তা বলে বোঝাতে পারব না! ভবিষ্যতে জাতীয় দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন আমার।’
জিলির বাড়ি উপজেলার ইলাশপুর গ্রামে।পিতার নাম ফয়জুদ্দিন। তিনি কৃষিকাজ করেন। মা সুরাইয়া বেগম জানান, সাত সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে তিনি হিমশিম খেয়ে যান। এ অবস্থার মধ্যেও মেয়েকে খেলা থেকে বিরত থাকতে দেননি। বাড়ি থেকে উপজেলা সদরে যেতে কষ্ট করে টাকা যোগাড় করে দিয়েছেন তিন।তবুও মেয়েকে সাহস ও উৎসাহ দিয়েছেন প্রতিনিয়ত। এখন বিদেশে যাওয়ার খবরে এলাকার মানুষের উৎসাহ দেখে জিলির পিতা-মাতাও খুশি।
জিলি গোলরক্ষক। তার ইচ্ছা জাতীয় দলে খেলার। মনের আনন্দে সে কেঁদে ফেলে।বিদেশ খেলতে যাচ্ছি এ আমার পরম সৌভাগ্য। দোয়া চাই সবার।যেন লাল-সবুজের পতাকার মান রাখতে পারি।
উপজেলার মোয়াজ্জমপুর ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামের দিনমজুর দুলাল মিয়ার মেয়ে তানিসা।থাকার জন্য নিজেদের নেই ঘর।থাকেন কাকার ঘরে। অসুস্থ মা মজিদা খাতুন জানান,মেয়ে ফুটবল খেলে,এতে তিনি অনেক কথা শুনেছেন।অনেক কষ্টে ধারকর্জ করে,ডিম বেচে মেয়ের প্র্যাকটিসের টাকা যোগাড় করেছেন। নিজেরা না খেয়েও মেয়েকে ভালোমন্দ খাইয়েছেন। মেয়ের এই সাফল্যে উচ্ছসিত তারা।গ্রামবাসীরও যেন আনন্দের শেষ নেই।
তানিসা খেলে রক্ষণভাগে। দলকে আগলে রাখার দৃঢ়তায় নজর কেড়েছে কোচদের।শত অভাবের ভিতরেও খেলা ছাড়েনি সে।ভবিষ্যৎে জাতীয় দলের হয়ে খেলতে চাই। সবার সহযোগীতায় পারবো আশা করি।সকলের দোয়া চাই।
তিন কিশোরী ফুটবলার জানান, যে নান্দাইলের এমপি আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিনের সার্বিক সহযোগীতা এবং কোচ মকবুল হোসনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই তাদের এই সাফল্য।
নান্দাইল পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল খালেক বলেন,‘আমার বিদ্যালয়ের মেধাবী কৃতি তিন ফুটবল খেলোয়াড় প্রশিক্ষণে পর্তুগাল যাচ্ছে এটা গর্বের বিষয়। তাদের সাফল্যে উচ্ছসিত প্রতিষ্ঠান। আমি তাদেরকে সবসময় উৎসাহ দিয়েছি।তাদের ভালোটা প্রত্যাশা করি।’