সোহেল খান দূর্জয় নেত্রকোণা প্রতিনিধি : দোয়েল (Magpie-robin) বাংলাদেশের জাতীয় পাখি। এ পাখি Passeriformes বর্গের অন্তর্গত Muscicapidae গোত্রের সদস্য। সাদা-কালোয় সজ্জিত বুলবুল আকৃতির খাটো লেজবিশিষ্ট এ পাখির বৈজ্ঞানিক নাম Copsychus saularis. বাংলাদেশে প্রায় সব জায়গায় দোয়েল দেখতে পাওয়া যায়।
পুরুষ দোয়েলের উপরিভাগ চকচকে নীলাভ-কালো। ডানা স্পষ্ট সাদা লম্বা দাগসহ কালচে বাদামি রঙের ও লেজ কালো তবে প্রান্তঅংশ সাদা। বাংলাদেশকে বলা হয় পাখির দেশ, গানের দেশ। গাছের ডালে ডালে পাখির কলকাকলিতে সবসময় মাতোয়ারা থাকতো গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি। এক সময়ে গ্রাম-গঞ্জের মাঠে-ঘাটে, বনে-জঙ্গলে, গাছে গাছে জাতীয় পাখি দোয়েলসহ বিভিন্ন ধরনের পাখি দেখা যেত। কিন্তু কালের আবর্তে এখন আর চিরচেনা সেই দোয়েল পাখি আর দেখা যায় না। পাখির কলরব বনে জঙ্গলে গাছে পাখি দেখার সেই অপরূপ দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে। এখন আর চোখে পড়ে না। বনাঞ্চলের পরিবেশ দূষণ, নির্বিচারে গাছ কাটা, জমিতে কীটনাশকের যথেষ্ট ব্যবহার, পাখির বিচরণ ক্ষেত্র ও খাদ্য সঙ্কট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিলুপ্তির পথে দোয়েলসহ দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন পাখি।
একসময় গ্রামবাংলায় পাখির সুমধুর ডাকে বাংলার মানুষের ঘুম ভাঙলেও গ্রাম-বাংলার আনাচে-কানাচে আগের মতো আর পাখির ডাক শোনা যায় না। হাওর-বাঁওড়, বিল শুকিয়ে যাচ্ছে, এছাড়াও শুকিয়ে যাচ্ছে আমাদের জলাভূমি, নদী-খালগুলো। ভরাট হয়ে যাচ্ছে পুকুর। এসব জলাভূমি, হাওর-বাঁওড় থেকে খাবার সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে পাখিগুলো।এছাড়াও বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে বিভিন্ন কারণে। এসব গাছগুলো পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে থাকে। পাখির আবাসস্থল নির্বিচারে ধ্বংস ও বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে কীটনাশক দেয়ার প্রভাবে এসব পাখি আজ বিলুপ্ত প্রায়। বিশেষ করে জাতীয় পাখি দোয়েলসহ আরো অনেক পাখি আর সচরাচর দেখা যায় না। শোনা যায় না এসব পাখির মধুর ডাক। উড়তে দেখা যায় না আর মুক্ত নীল আকাশে।বর্তমান সময়ের ছেলে মেয়েরা এসব পাখি হয়তো চোখেই দেখেনি, অনেকেই এসব পাখির নামও জানে না। ফলে তরুণ প্রজন্মের কাছে এসব পাখি হয়ে যাচ্ছে গল্প আর ইতিহাস। এমনকি আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েল পাখিকেও ছবি অথবা বই দেখে চিনতে হয় শিশু-কিশোরদের। এ প্রজন্মের অনেক শিশু-কিশোর কখনো দেখেনি মুক্ত আকাশে উড়ন্ত এসব নামকরা পাখি, শোনেনি এসব পাখির ডাকও।
বাংলার এসব ঐতিহ্যবাহী পাখিগুলো এভাবেই মানুষের অজান্তেই হারিয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন এবং বারহাট্টা ও কেন্দুয়া এবং দূর্গাপুর উপজেলা থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে জাতীয় পাখি দোয়েল। এ পাখি এখন যেন চোখের আড়ালে। সচরাচর আর দেখা যায় না দোয়েলকে। ঝোপঝাড়ে, রাস্তার পাশে, অফিস বা বাড়ির ছাদে জাতীয় পাখি দোয়েলের ছুটে চলা এখন আর চোখে পড়ে না। শোনা যায় না দোয়েল পাখির সুমিষ্ট কণ্ঠ। প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন অফিস, বাড়ি বা রাস্তার পাশের এ গাছ থেকে অপর গাছে বিচরণ করে বেড়াতে দেখা যেত গ্রাম-বাংলার পরিচিত ছোট্ট পাখি দোয়েলকে। তাদের জাদুকরি কণ্ঠের ডাকাডাকিতে মন ভোলাতো সব বয়সী মানুষের।
কাক-চড়–ইয়ের মতো গ্রামের মানুষের সঙ্গে সংঘ ছিল। খুব কাছে গেলেও উড়ে যেত না এ পাখিগুলো। তবে মাঝে মাঝে দেখা যেত একে অপরের সঙ্গে আনন্দ করে ডানা দোলাচ্ছে এবং সামান্য ঝগড়া করতেও দেখা যেত দুটি পাখিকে। সাদা আর কালো রংয়ের ছোট দোয়েল পাখির সঙ্গে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িয়ে রয়েছে। এক সময় গ্রাম-বাংলার মানুষের ঘুম ভাঙতো পাখিদের কলকাকলিতে কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম-বাংলা থেকে শূন্য হয়ে যাচ্ছে দেশীয় এসব পাখি। সকাল হলেই আগের মতো এখন আর দোয়েলের চি চি শব্দ শোনা যায় না বললেই চলে।যে পাখিকে সব সময় মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে দেখা যেত, মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করতো, কালের পরিক্রমায় সে আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
বারহাট্টা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক ফেরদৌস আহমাদ বাবুল বলেন, প্রতিনিয়ত আমরা ধ্বংস করছি আমাদের সবুজ বৃক্ষ। নির্বিচারে বৃক্ষনিধনের মাধ্যমে পাখিদের আবাসস্থান ধ্বংস এবং বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে ক্ষতিকারণ কীটনাশক প্রয়োগের ফলে দিন দিন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে চিরচেনা এসব পাখি। তাই এখন আর খুব একটা শোনা যায় না আমাদের জাতীয় মায়াবী পাখি দোয়েলের মধুর ডাক। শুধু তাই নয়, বৃক্ষনিধনের পাশাপাশি পাখি শিকার বিষয়ে আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। এটা কারো চোখেও পড়ছে না। ফলে প্রকৃতি থেকে দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে চিরচেনা দেশীয় এসব পাখিগুলো। নেত্রকোণা সদর উপজেলার পাখি প্রেমী মাসুম হাসান জামাল বলেন, দোয়েলসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির পথে। নতুন প্রজন্ম ওই পাখি দেখতে পান না। তাই বাধ্য হয়ে বাড়িতে বসেই বেশ কিছু প্রজাতির পাখি পালন করেছি। যাতে করে নতুন প্রজন্ম পাখি সম্পর্কে জানতে পারে।
নেত্রকোণার সচেতন মহল মনে করেছেন, নদী ভাঙনের ফলে ফসলি জমিতে উঠছে ঘরবাড়ি, তা ছাড়া জনসংখ্যার প্রভাবেও কোথাও না কোথায়ও প্রতিদিন নতুন নতুন ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে। এতে গাছ কেটে বন উজাড় করে পাখিদের আবাসস্থল ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে।
দূর্গাপুর উপজেলার পাখি প্রেমী শফিকুল ইসলাম সজীব বলেন, জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় পাখি মরে যাচ্ছে, আবার খাদ্য সঙ্কট ও আবাসস্থল কমে যাওয়ায় পাখি বংশ বিস্তার করতে পারছে না, এতে কমে যাচ্ছে পাখি। তাই পরিবেশ রক্ষা জরুরি বলে মনে করছেন তারা।বেশি মুনাফার আশায় বনে চোরা শিকারিরা বিভিন্ন ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করে বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে শিকারের হাত থেকে বাঁচাতে জীবন রক্ষায় পাখি অন্যত্র চলে যাচ্ছে। অনেক সময় তাদের হাতে মারাও যাচ্ছে পাখি। অথচ প্রশাসনের তেমন কোনো তৎপরতা নেই। সচেতন ও অভিজ্ঞ মহল জানায়, শিকারীরা অবৈধভাবে বনে প্রবেশ করে বন্য প্রাণী ও পক্ষিকুল হত্যা করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন সরকার ১৯৬১ সালে গঠিত বন্য প্রাণী তহবিল সমতল ভূমির বনের অবলুপ্ত রক্ষার্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়নি বলে অনেকাংশে এর জন্য দায়ী। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে বন্য প্রাণী সংরক্ষণে বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবন করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বন্য প্রাণী সংরক্ষন আইন, নির্ধারিত বনাঞ্চল সৃষ্টি, উদ্যান প্রতিষ্টা, শিকার সংরক্ষিত এলাকা সৃষ্টি, বন্য প্রাণী নিবাস এবং বিনোদন পার্ক স্থাপন।
সচেতন মহলের অভিমত, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য সরকারের উচিৎ আইন প্রণয়ন করে পাখি শিকারের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ জোরদার করা, সরকারি-বেসরকারিভাবে পক্ষীকুল সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে এক সময় ধ্বংস হয়ে যাবে এদেশের বন্য প্রাণী ও ইতিহাস ঐতিহ্য স্মৃতি জড়িত দোয়েলের মত পাখি।স্ত্রী দোয়েলের দেহের কালো অংশগুলি বাদামি এবং ময়লা বালির মতো দেখায়। গাছের প্রাকৃতিক খোঁড়লে কিংবা ঝোপঝাড়ে এরা বাসা বাঁধে। সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় ঝোপঝাড়যুক্ত বন, বাগান, গ্রাম তথা লোকালয়ে এদের দেখতে পাওয়া যায়।
মিষ্টি মোলায়েম শিস দেয়। লেজের ডগা নাচায়। স্থিরভাবে বসা অবস্থায় দোয়েলের লেজ মোরগের লেজের মতো দেখায়। প্রজনন ঋতুতে পুরুষ দোয়েল খুব ভোরে এবং পড়ন্ত দুপুরে সুরেলা গলায় অত্যন্ত জোরে গান গায়। অন্য পাখির ডাকও এরা নকল করতে পারে। দোয়েল প্রধানত পোকা-মাকড়, কীটপতঙ্গ খায়। এপ্রিল থেকে জুলাই মাস এদের প্রজনন ঋতু। স্ত্রী দোয়েল ৩-৫ টি ডিম দেয়। সাধারণভাবে ডিমগুলো ফ্যাকাশে মনে হয়। তবে দোয়েলের ডিমের রং লালচে-বাদামি আভা ও ছোপযুক্ত নীলাভ সবুজ হয়ে থাকে। স্ত্রী দোয়েল ডিমে তা দেয়। দোয়েল ১৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে।