সোহেল খান দূর্জয় নেত্রকোণা প্রতিনিধি : স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়তে শুরু করেছে নেত্রকোণাবাসী। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে নেত্রকোণা সদর, খালিয়াজুরী, মদন, মোহনগঞ্জ, বারহাট্টা, আটপাড়া, কেন্দুয়া, কলমাকান্দা, দূর্গাপুর ও পূর্বধলার কয়েক শত বসত ঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে।
খালিয়াজুরী ও মোহনগঞ্জ উপজেলার কিছু কিছু বসত ঘরের ভিতরে কোমর পযর্ন্ত পানিতে ডুবে আছে।বানভাসী মানুষ জানমাল রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্ত উজানের ঢল ও দিনভর ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে হু হু করে পানি ঢুকছে বসত ঘরে। সাংসারিক জিনিসপত্র চৌকি খাটের উপরে তুলে রেখেও শেষ রক্ষা করতে পারছেন না। টিভি, ফ্রিজসহ লক্ষ লক্ষ টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী এখন বানের পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে। পুরো নেত্রকোণা জেলার ৭০ ভাগ বসত ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। খালিয়াজুরী উপজেলার শতভাগ এলাকা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে।
খালিয়াজুরী ও মদন উপজেলা এলাকার কিছু কিছু সড়ক হাঁটু পানি থেকে কোমর পানিতে ডুবে আছে। জেলার প্রধান সড়ক গুলোতে অনায়াসে নৌকা চলাচল করছে। ৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মদন-খালিয়াজুরী সড়কের কিছু কিছু স্থান কোমর পানিতে ডুবে থাকায় নেত্রকোণার সঙ্গে খালিয়াজুরী ও মোহনগঞ্জ উপজেলা কিছু কিছু সড়কের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে। জেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে খালিয়াজুরী উপজেলা। এসব এলাকার প্রধান সড়ক এখন সাঁতার কাটার মতো নিমজ্জিত। নৌকা ছাড়া খালিয়াজুরী উপজেলায় যাওয়ার বিকল্প কোনও বাহন নেই। বারহাট্টা উপজেলার আলোকদিয়া, বাদে চিরাম, গাইনপাড়া, পালপাড়া, নরুল্লা বোয়ালজানা,সাবানিয়া, সাহতা, ফকিরের বাজার, ডেমুরাসহ ৭টি ইউনিয়নে পাঁচ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ডুকে পড়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার ব্যবসায়ীসহ মৎস্যজীবী।
বন্যার কারণে নেত্রকোণা জেলার কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।খালিয়াজুরীর বসতবাড়ির কিছু কিছু বিদ্যুতের মিটার পানিতে ডুবে গেছে।
নেত্রকোণার ও খালিয়াজুরী উপজেলা জুড়ে এখন থইথই পানি। এমন কোনও এলাকা ও সড়ক নেই যেটি বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়নি। নেত্রকোণায় পানি আর পানি। কোথাও হাঁটু, কোথাও এর চেয়ে বেশি পানি। বিভিন্ন এলাকায় পানি বেশি থাকায় সেখানে নৌকায় যাতায়াত করেছেন লোকজন।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জানান, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সহায়তার জন্য বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্হা করা হচ্ছে।বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। বন্যাদুর্গত মানুষজন তাদের গৃহপালিত গবাদিপশুসহ পরিবার পরিজন নিয়ে পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে। সেই সঙ্গে বন্যার চরম অবনতি হওয়ার পরও জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকায় স্কুলপড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট নৌকায় স্কুলে যাচ্ছে। এতে করে যে কোনও সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা বা প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন অভিভাবকরা। পাশাপাশি প্রবল বজ্রপাত ঘটার ফলে এমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় হাওরাঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছেন তারা।
নেত্রকোণা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ১৫ জুন বুধবার সকাল থেকেই ধনু নদী দিয়ে বিপদসীমার ১.৬ মিলিমিটার উপর দিয়ে ঢলের পানিতে খালিয়াজুরী উপজেলায় নতুন করে বন্যা পরিস্থিতি চরম অবনতির দিকে ধাবিত হয়েছে। জেলার সবকটি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যার ফলে প্লাবিত হচ্ছে জেলার নতুন নতুন গ্রাম।
নেত্রকোণা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, এমন ভারী বৃষ্টিপাত ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আরও বেশ কয়েক দিন থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
নেত্রকোণা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জানান, জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশিরভাগই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করায় সেগুলোতে পাঠদান সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গত ১০/১২ দিনের টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ী ঢলে জেলার নির্মাঞ্চল প্লাবিত হয়ে শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে জেলা সদরের সঙ্গে গত ৪/৫ দিন ধরে বেশ কয়েকটি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে। প্রবল বর্ষণে মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা সীমান্তের বিভিন্ন ছড়া দিয়ে প্রবল স্রোতের পানি প্রবেশ করছে।কংশ নদীর পানির প্রবল স্রোতে প্রায় বেশ কিছু গ্রাম ভাঙ্গনের হুমকিতে রয়েছে।
জেলার আরও কয়েকটি স্থান প্লাবিত হওয়ায় যান চলাচল বন্ধ আছে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্যায় প্লাবিত হয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এসব এলাকার গ্রামীণ ছোট ছোট রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
ধনু নদীর প্রবল স্রোতের তোড়ে খালিয়াজুরী বাজার সংলগ্ন ধনু নদীর পাড় ভেঙে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ এএইচএম আরিফুল ইসলাম বলেন, প্রবল বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলে বর্তমানে উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি ব্যাপক অবনতির দিকে যাচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত খালিয়াজুরীতে পর্যটকবাহী সব নৌযানের চলাচল বন্ধ রয়েছে।
জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে জেলার বন্যাদুর্গতদের জন্য খাদ্য সামগ্রী বরাদ্দ রয়েছে। বরাদ্দকৃত খাদ্য সামগ্রী প্রতিটি ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে বিতরণের ব্যবস্হা রয়েছে। ইতোমধ্যেই কয়েকটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা বন্যাদুর্গত মানুষদের মধ্যে তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেছেন।
বন্যাদুর্গত মানুষকে সংকট মুহূর্তে কন্ট্রোল রুমের দেওয়া মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগের ব্যবস্হা করা হয়েছে। ব্যাপক বজ্রপাত ঘটায় এই দূর্যোগপূর্ণ পরিবেশে জেলাবাসীকে ঘর থেকে বের না হওয়া এবং মনে সাহস নিয়ে বন্যা মোকাবিলার আহবান জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিস।
টানা বৃষ্টির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ বিপাকে পড়েছেন। দীর্ঘ কয়েক দিন ধরে আয় রোজগার বন্ধ রয়েছে। বানভাসী মানুষ উচ্চ মূল্যে নৌকা ভাড়া করে এলাকার প্রাণকেন্দ্রে যাতায়াত করছেন। হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে আছে। গ্রামের মানুষ গবাদিপশু, হাস, মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।